কৃষি পাল্টে দিয়েছে বিদেশফেরত মো. মাজাহারুল ইসলামের (৩০) জীবন। দীর্ঘ পাঁচ বছর প্রবাসজীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে নতুন কিছু করার চেষ্টায় কৃষিতে মনোযোগী হন তিনি। প্রথম পর্যায়ে ১৪ লাখ টাকা দিয়ে কেনেন একটি কম্বাইন হার্ভেস্টার মেশিন। একসময় ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়েন ফসল উৎপাদনে। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে লাভজনক ও ব্যতিক্রমী চাষাবাদের ধারণা পান তিনি। নতুন উদ্যমে পথচলা শুরু হয়। সফলতা ধরা দেয় তার হাতে।
রাজশাহীর মাটিকাটা ইউনিয়নের বেণীপুরের মো. ওয়াদুদ আলীর ছেলে মো. মাজাহারুল ইসলাম। পরিবারের সাত ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি। পড়াশোনার প্রবল ইচ্ছে থাকলেও আর্থিক দৈন্যে খুব বেশিদূর এগুতে পারেননি। ২০০৭ সালে এসএসসি পরীক্ষার পরই ইতি টানতে হয় লেখাপড়ার। বাবার সাথে আবারও মাঠে ফিরতে হয় তাকে।
একসময় সখ জাগে বিদেশ যাওয়ার। শিখে ফেলেন কোরিয়ান ভাষা। ২০১৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সরকারিভাবে দক্ষিণ কোরিয়ায় যান শ্রমিক হিসেবে। সেখানে প্রায় পাঁচ বছর একটি কোম্পানিতে কাজ শেষে ২০১৮ সালের ৯ জুলাই দেশে ফেরেন মাজাহার। দেশে ফিরে কোরিয়ান ভাষাশিক্ষার কোর্স চালু করেন। ‘আশা কোরিয়ান ল্যাংগুয়েজ ট্রেনিং সেন্টার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানও দেন তিনি। শুরুতে ভালো করলেও করোনা মহামারির কারণে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি।
এরপর কৃষিতে মনযোগী হন মাজাহারুল। কেনেন একটি কম্বাইন হার্ভেস্টার মেশিন। সরকারি ভর্তুকি বাদে মেশিনটি কিনতে খরচ হয় ১৪ লাখ টাকা। কিছুদিন যেতে না যেতেই যন্ত্রটি নিয়ে পড়েন বিড়ম্বনায়। যার কারণে প্রায়ই তাকে যেতে হয় উপজেলা কৃষি অফিসারের কাছ। এতে যন্ত্রের সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি কৃষির ওপর পান নানা পরামর্শ। লাভজনক ও ব্যতিক্রমী চাষাবাদের ধারণা পান সেখান থেকে। বিদেশি চায়না বরই, মাল্টা, কমলা, পেয়ারা ও সিডলেস লেবুর চাষাবাদ শুরু করেন।
উঁচু জমির কারণে মৌসুমী ও রবিশস্যে আবাদ খুব একটা ভালো হয় না। আর তাই বাবার কাছে থেকে পাওয়া নিজ অংশের দেড়বিঘা জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে নিজেই চায়না জাতের ‘বল সুন্দরী’ বরই চাষ শুরু করেন। এতে সহায়তা করেন উপজেলা কৃষি অফিসার মো. শফিকুল ইসলাম ও গোদাগাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার মো. মতিউর রহমান।
নিজের আবাদী জমির পাশের ৪৫ বিঘা জমি লিজ নেন চার প্রবাসীবন্ধু মিলে। নিজ জমিসহ মোট সাড়ে ৪৬ বিঘা জমিতে শুরু করেন ফল ও সাথীফসলের চাষাবাদ। এর মধ্যে সাত বিঘা জমিতে এক হাজার ৪০০ চায়না জাতের ‘বল সুন্দরী’ বরই গাছ লাগান। এছাড়াও সাথীফসল হিসেবে মাল্টা, সিডলেস লেবু ও কমলা গাছের ফাঁকে আরও দুই হাজার ২০০ বরই গাছ লাগান তিনি।
গত জানুয়ারি থেকে বরই তুলতে শুরু করেন মাজাহারুল। ওই মাসের ৮ তারিখ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ টাকার রবই বিক্রি করেছেন তিনি। ছয় বিঘা জমিতে দুই হাজার ৪০০ থাই গোল্ডেন পেয়ারা, ছয় বিঘা জমিতে চায়না, দার্জিলিং, মান্দারিন জাতের ৭০০ কমলা, ছয় বিঘা জমিতে ‘বারি-১’ জাতের ৭০০ মাল্টা, ১৮ বিঘা জমিতে বারমাসী ছয় হাজার সিডলেস লেবু ও এক বিঘা জমিতে ১০০ কাজুবাদাম গাছ লাগিয়েছেন তিনি।
এছাড়াও আড়াই বিঘা জমিতে জাপানের জাতীয় ফল পারসিমন, পাকিস্তানি আনার, তুরস্কের ত্বীন, থাইল্যান্ডের লংগন (কাঠলিচু), অস্ট্রেলিয়ার সাত মসলা, ব্রুনাইয়ের জাতীয় ফল রাম্বুটানসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাতের ফুল ও সবজির আবাদ করেছেন মাজাহারুল।
এ বিষয়ে মাজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর বরই বিক্রি করে প্রায় ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা আয় হবে। ফুলকপি, বাঁধাকপি ও টমেটো বিক্রি করে বেশকিছু টাকা আয় হয়েছে। অন্যান্য ফল ও ফসল উৎপাদন করে প্রথম বছরেই বিনিয়োগের ২৫ লাখ টাকা উঠে বেশ লাভ হবে আমাদের।’
তিনি বলেন, ‘বিদেশ থেকে ফিরে কৃষিতে ব্যতিক্রমী চিন্তাধারায় চাষাবাদ করে আমি সফল। কৃষিকাজও একটি ব্যবসা। ব্যবসায় শ্রম ও সময় দিলে তা কখনও নিরাশ করে না। আমার গ্রামের কৃষক কিংবা শিক্ষিত তরুণরা চাকরির পেছনে না ছুটে আমার মতো কৃষিতে এগিয়ে এলে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।’
গোদাগাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার মো. মতিউর রহমান বলেন, ‘চার বন্ধু মিলে ৪৬ বিঘা জমিতে ফল ও বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন শুরু করে। আমরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করি। তাদের মতো কৃষিতে এগিয়ে এলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সবাইকে সহযোগিতা করবে।’
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক শামসুল হক বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে উঁচু জমিতে পানির সঙ্কটের কারণে ধান-গমের চেয়ে ফলের আবাদ ভালো হয়। তাছাড়া উঁচু জমি ফল চাষের জন্য উপযোগী, পানিও কম লাগে। সেক্ষেত্রে মাজাহারুলকে চিরাচরিত চাষাবাদের পরিবর্তে লাভজনক ফল চাষের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ থেকে পরামর্শ ও সরকারি সহায়তা করা হয়। এতে সে সফলতাও পেয়েছে।’
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস